মাতৃভাষাই শিক্ষার প্রকৃত বাহন
___________________________________
একটি শিশু জন্মানোর পর প্রথম যে শব্দটি সে উচ্চারণ করে তা তার মাতৃভাষাতেই করে থাকে। পিতা-মাতা বা বাড়ির অন্যান্যদের কাছ থেকে অর্থাৎ, তার পরিবেশের মধ্যে সে যা শোনে, যা দেখে সেটিই সে উচ্চারণ করে থাকে। সেই দেখা-শোনা মাতৃভাষাতেই যত সাবলীল ভাবে প্রকাশ করা সম্ভব, অন্য কোনো ভাষায় তা সম্ভব হয় না।
ইতিহাসের প্রতি ধাপে মানুষ প্রকৃতির পাঠশালায় শিক্ষা গ্রহণ করে সভ্যতাকে ক্রমাগত উন্নতির পথে নিয়ে গেছে। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের মানুষ সে শিক্ষালব্ধ অভিজ্ঞতাকে নিজের ভাষাতেই উপলব্ধি করেছে। সুতরাং অন্য সব পরবর্তী গবেষণার কথা ছেড়ে দিলেও একথা সহজবোধ্য যে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা লাভেই সর্বশ্রেষ্ঠ পথ। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে এর অন্যথা হচ্ছে।
ইংরেজ উপনিবেশবাদ থেকে আমাদের স্বাধীনতা লাভের পর প্রায় সাত দশক সময় অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা আমরা বোধহয় এখনও পাইনি। তাই শিক্ষাঙ্গন বা সরকারি কাজের ক্ষেত্রে এখনও বাংলা ভাষা প্রায় ব্রাত্য হয়ে আছে। আমরা প্রতিদিন দেখছি অভিভাবকেরা বাস্তব পরিস্থিতি বিচার করে তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে ভর্তি করছেন। শুধু তাই নয়, বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলি ক্রমাগত মুমূর্ষু হয়ে পড়ছে। কেরিয়ার সচেতন পিতা-মাতার সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়ানোর ঝোঁক ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে। আমরা ভাবছিনা যে যেকোনো বিষয় পড়লে মনে মনে তাকে মাতৃভাষাতেই বুঝে নিই। শুধু তাই নয় সেই উপলব্ধিকৃত বিষয়কে অন্য ভাষায় প্রকাশ করতে গেলে আমরা তাকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেই প্রকাশ করি। সুতরাং বোঝা ও প্রকাশ করার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম সর্বদাই মাতৃভাষা। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু পর্যন্ত সকলেই মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের সপক্ষে বলে গেছেন। মাতৃভাষাকে অবহেলা করে অন্য কোনো ভাষা রপ্ত করা এক দুরূহ কাজ। ভাষাবিদরা বলেন, একটি ভাষায় যে বা যারা দক্ষ তাদের পক্ষে অন্য ভাষা আয়ত্ত করতে বেগ পেতে হয় না। সেক্ষেত্রে সাধারণত যে কোনো শিশুর কাছে তার মাতৃভাষার চেয়ে অন্য ভাষায় দক্ষ হওয়া সহজ হয় না।
বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতের বিচারে এ কথা অবশ্য মান্য যে ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজন এদেশে এখনও গুরুত্বপূর্ণ হয়েই রয়ে গেছে। সত্যি কথা, ইংরেজি আজ বিশ্বের কাজের ভাষা, ভাব প্রকাশের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তায় বিশ্বায়নের যুগে এই ভাষায় কাজ চালানোর মতো বিদ্যা না থাকলে চলা মুশকিল। সুতরাং আমরা ইংরেজি শিক্ষার বিরোধী নই। এ ভাষার সমৃদ্ধি ও সাহিত্য সম্ভারকে আমরা শ্রদ্ধা করি। তাই আমাদের কাম্য এই যে শিক্ষার মাধ্যম হোক মাতৃভাষা কিন্তু সমান্তরালভাবে দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে ইংরেজি ভাষা গুরুত্ব পাক। এদেশে শিল্প, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, ধর্ম, রাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি যে কোনো ক্ষেত্রে যারা মহৎ অবদান রেখেছেন, লক্ষ করলে দেখা যাবে তাঁদের প্রায় সকলেই মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করেছিলেন। এতে প্রমাণিত হয় যে মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভ শিশুর নিহীত শক্তির বিকাশের সহায়ক।
আশা করি এ বিষয়ে শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ সহায়ক হবেন অন্যথায় তাঁদের মতামতকে তুলে ধরার অনুরোধ জানাই। একই সঙ্গে প্রত্যাশা রাখি যে শিক্ষা বিভাগ ও মানব সম্পদ উন্নয়ন দফতর এই মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের বিষয়কে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।